ডিজিটাল বাংলাদেশে বিদেশনির্ভর ইন্টারনেট অবকাঠামো: এক ভয়ংকর ঝুঁকি

ইন্টারনেট
2

🔍 ভূমিকা

বর্তমান বাংলাদেশে ইন্টারনেট ছাড়া এক মুহূর্তও কল্পনা করা যায় না। নাগরিক সেবা থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ বিল, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন শিক্ষা—সবকিছুই আজ ইন্টারনেটনির্ভর।

কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, যদি হঠাৎ আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়—তাহলে কী হবে?


⚠️ বাস্তব অভিজ্ঞতা: জুলাই ২০২৪

২০২৪ সালের জুলাই মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় সরকার কিছু এলাকায় ইন্টারনেট সীমিত করে। ফলে দেখা দেয় বিভিন্ন সমস্যা:

  • 🔋 প্রিপেইড বিদ্যুৎ মিটার রিচার্জ করতে মানুষ বিপাকে পড়ে
  • 💸 বিকাশ ও নগদের মতো মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধ হয়ে যায়
  • 🏦 ব্যাংকিং কার্যক্রম অনেকাংশেই স্থবির হয়ে পড়ে
  • 🖥️ সরকারি অনেক ওয়েবসাইট অচল হয়ে যায়

অথচ এসব সেবার অনেক কিছুই দেশের ভেতরে হোস্ট করা ছিল!


🧠 সমস্যা কোথায়?

১. বিদেশি ডোমেইন ও DNS নির্ভরতা

  • বেশিরভাগ সেবা .com, .net ডোমেইনে।
  • DNS সার্ভার হিসেবে ব্যবহৃত হয় Cloudflare, Google ইত্যাদি বিদেশি সার্ভার।
  • ফলে আন্তর্জাতিক ট্রাফিক ছাড়া DNS Resolve সম্ভব হয় না।

২. Cloudflare Proxy ব্যবহারের ঝুঁকি

অনেক প্রতিষ্ঠান Cloudflare এর Web Proxy ব্যবহার করে ওয়েবসাইট চালায়। এতে নিরাপত্তা বাড়লেও, ইন্টারন্যাশনাল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে সাইটে ঢোকা যায় না—এমনকি যদি সার্ভার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকে।


🔧 একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক

একজন গ্রাহক প্রিপেইড বিদ্যুৎ মিটার রিচার্জ করতে চাইলেন বিকাশ অ্যাপে। অ্যাপ, সার্ভার, সব বাংলাদেশেই। কিন্তু বিকাশের ডোমেইন .com এবং DNS Cloudflare-এ।

যদি আন্তর্জাতিক DNS ব্লক হয়—তাহলে অ্যাপ সার্ভারের ঠিকানা resolve করতে পারবে না।
👉 অ্যাপ অচল, অথচ ইন্টারনেট রয়েছে!


✅ করণীয়: কীভাবে বিপদ এড়ানো যায়?

🟢 ১. ডোমেইন স্থানান্তর

  • গুরুত্বপূর্ণ সরকারি/অর্থনৈতিক সেবা .bd বা .বাংলা ডোমেইনে স্থানান্তর করতে হবে।
  • .bd ডোমেইনের নিয়ন্ত্রণ বিটিসিএলের হাতে।

🟢 ২. DNS সার্ভার দেশের ভেতরে

  • প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ডোমেইনের কমপক্ষে একটি Authoritative DNS সার্ভার বাংলাদেশে হোস্ট করতে হবে।

🟢 ৩. ISP DNS বাধ্যতামূলক

  • সকল আইএসপি’র Recursive DNS Resolver বাংলাদেশে থাকতে হবে।
  • বিটিআরসি কর্তৃক এটি তদারকি করা সম্ভব।

🟢 ৪. Cloudflare/Web Proxy বিকল্প

  • Local CDN বা দেশীয় Cloud Proxy সল্যুশন গড়ে তুলতে হবে।
  • Open Source DNS ও Reverse Proxy সল্যুশন ব্যবহার করতে উৎসাহ দিতে হবে।

🚀 Starlink-এর মতো সেবা: প্রযুক্তির অগ্রগতি, কিন্তু সাবধানতা জরুরি

বাংলাদেশে Starlink-এর মতো স্যাটেলাইট ইন্টারনেট প্রযুক্তি আলোচিত হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি আধুনিক ও দ্রুতগতির সেবা, বিশেষ করে দুর্গম অঞ্চলের জন্য। কিন্তু এটি একটি সম্পূর্ণ বিদেশি মালিকানাধীন সেবা, যার কন্ট্রোল, সিগন্যাল রাউটিং, DNS ও অ্যাক্সেস ম্যানেজমেন্ট সবকিছুই বাংলাদেশের বাহিরে।

যদি কখনো Starlink কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় সেবা বন্ধ করে দিতে, অথবা আন্তর্জাতিক সংযোগে সমস্যা হয়, তাহলে সেই অঞ্চলের মানুষ বা সেবা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান মুহূর্তেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।

🔁 তাই প্রযুক্তি গ্রহণ করলেও, বিদেশি সেবার পাশাপাশি দেশে বিকল্প পরিকাঠামো ও কন্টিনজেন্সি প্ল্যান থাকা অত্যন্ত জরুরি।

🧩 উপসংহার

বাংলাদেশে এখন ডিজিটাল বিপ্লব ঘটছে। এই সময়ে আমাদের প্রযুক্তি অবকাঠামো যদি বিদেশনির্ভর হয়, তবে যে কোনো দুর্যোগেই সব থমকে যাবে।
✅ তাই সময় এসেছে, প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেওয়ার।

ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব মানে শুধু ইন্টারনেট ব্যবহার নয়, বরং ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণও আমাদের হাতে থাকা।

জাহেদুল ইসলাম
ব্যবস্থাপক (কারিগরি), বিটিসিএল


🗨️ আপনার মতামত জানান

এই আর্টিকেলটি কেমন লাগলো? আপনি কী ভাবছেন বাংলাদেশের ডিজিটাল অবকাঠামো নিয়ে? নিচে কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না।

স্টারলিংক ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি প্রযোজ্য।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা যাবে না। বিকল্প সবসময় রাখতে হবে।

নীতিপত্র খসড়া: ডিজিটাল স্বনির্ভরতা ও নিরাপত্তা রক্ষায় জাতীয় কৌশল

শিরোনাম:
বিদেশনির্ভর ডিজিটাল অবকাঠামো: বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য এক সুপ্ত বিপদ
তারিখ: এপ্রিল ২০২৫
উদ্যোক্তা: জাতীয় নিরাপত্তা ও ডিজিটাল সক্ষমতা সেলের জন্য উপস্থাপিত

ভূমিকা:

বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তর ইতোমধ্যে অভূতপূর্ব গতিতে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এই অগ্রগতির আড়ালে একটি গভীর সংকট বাড়ছে—আমাদের ইন্টারনেট অবকাঠামোর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি এবং বিদেশি নির্ভরতাজনিত নিরাপত্তা ঝুঁকি।

সমস্যার চিত্রণ:
1. বিদেশনির্ভর ব্যাকবোন ও সাবমেরিন কেবল:
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথ, ক্লাউড সেবা, DNS/ISP নিয়ন্ত্রণ মূলত বিদেশি নিয়ন্ত্রিত সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এটি দেশের ওপর কৌশলগত চাপ তৈরি করতে পারে।
2. তথ্য সুরক্ষা ও ডেটা সার্বভৌমত্ব:
বাংলাদেশি নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিদেশি সার্ভারে সংরক্ষিত হওয়ায় জাতীয় তথ্যপাচার, মনিটরিং এবং সাইবার হস্তক্ষেপের আশঙ্কা বাড়ছে।
3. আইনি ও নীতিগত দুর্বলতা:
সাইবার নিরাপত্তা ও ডেটা সুরক্ষার বিষয়গুলোতে সমন্বিত ও যুগোপযোগী আইন এখনো সীমিত পরিসরে বিদ্যমান।

নীতিগত সুপারিশসমূহ:

১. স্বাধীন ডিজিটাল অবকাঠামো গঠন:
• নিজস্ব সাবমেরিন কেবল ও ক্লাউড ডেটা সেন্টার স্থাপন।
• জাতীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত DNS ও Root Server স্থাপন।
• সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য নিজস্ব সার্ভার ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক স্থানান্তর।

২. ডেটা সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণ:
• একটি স্বাধীন “জাতীয় ডেটা প্রটেকশন কমিশন” গঠন।
• ব্যক্তিগত ও সরকারি ডেটা বিদেশে হোস্টিং বন্ধে আইন প্রণয়ন।
• Sensitive Data Localization বাস্তবায়ন।

৩. সাইবার নিরাপত্তা শক্তিশালীকরণ:
• এক্সপার্ট টাস্কফোর্স গঠন করে National Cyber Defense Framework তৈরি।
• “সাইবার আক্রমণ = জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি” এই নীতির বাস্তবায়ন।

৪. স্থানীয় প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন:
• বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্ডাস্ট্রি সংযোগের মাধ্যমে Local Cloud Tech, AI Security ও Network Infrastructure ট্যালেন্ট ডেভেলপমেন্ট।
• রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় “Digital Defense Startup Incubator” প্রতিষ্ঠা।

৫. আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও বিকল্প সংযোগ:
• নিরপেক্ষ ও বহুমুখী আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটি (e.g., ভারতের বাইরে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা ইউরেশিয়া সংযোগ) গড়ে তোলা।

উপসংহার:

জাতীয় স্বার্থে, ডিজিটাল অবকাঠামোকে স্বাধীন, নিরাপদ এবং টেকসই করতে হবে। বিদেশি প্রযুক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতাকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ভবিষ্যতের সংকট আরও ভয়াবহ হতে পারে। এখনই সময় একটি “ডিজিটাল সার্বভৌম বাংলাদেশ” গঠনের কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণের।

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।